বর্তমানে বাচ্চা প্রসবের পদ্ধতি হিসেবে সি সেকশন বা সিজার খুবই কমন একটি অপারেশন। যদিও আমরা ই সি সেকশন অপারেশন নিজ থেকে পরামর্শ দেই না। কিন্ত আমাদেরকে জানতে হবে আমরা নরমাল ডেলিভারির জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিলেও কিছু কিছু পরিস্থিতি তে নরমাল ডেলিভারি সম্ভব হয় না কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে। তখন সি সেকশন অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের পরামর্শ দেয়া হয়। এজন্য আমাদের এটার জন্যও মানসিক প্রস্তুতি রাখা উচিত যেন পুরো সময় সব ঠিক থাকার পরও কোনো কোনো পরিস্থিতিতে সি সেকশন দরকার ও হতে পারে। মনে রাখতে হবে আমার জন্য যা কল্যাণকর আল্লাহ তা ই করবেন।
সি সেকশন পদ্ধতি সম্পর্কে একটু জেনে নেই চলুন।
সিজারিয়ান পদ্ধতি
সি সেকশন একটি অস্ত্রোপচার পদ্ধতি যেখানে ত্বক, তক্বের নিচের চর্বি, পেটের পেশি, পেটের পর্দা, জরায়ু কেটে বাচ্চা বের করা হয়। অপারেশন এর আগে কিছু প্রস্তুতি আছে যেমনঃ
– অপারেশন এর ৬-৮ ঘন্টা আগে থেকে সব রকম খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকতে হবে।
– সি সেকশন অপারেশনের এর আগে আপনার কোমড় থেকে পা ( আংশিক) বা পুরোপুরি অজ্ঞান করা হয়। অবস্থার উপর নির্ভর করে এটা নির্ধারণ করা হয়।
– এনেস্থিসিয়া দিয়ে অজ্ঞান করার পূর্বে এনেস্থিসিয়া ও অপারেশন এর ঝুঁকি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আপনার পরিবারের সদস্যকে একটি বিশেষ ফর্মে সম্মতিসূচক সই করতে হয়।
– সি সেকশন অপারেশনের পুরো প্রক্রিয়া টি সম্পন্ন হতে ৩০-৫০ মিনিট সময় লাগতে পারে।
আমাদের জানা উচিত কোন কোন পরিস্থিতি তে সি সেকশন দরকার হতে পারেঃ
কখন সিজার করাতে হয়?
গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের সময় এমন কিছু পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন মা ও শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য সি সেকশন দরকার হতে পারে। কিছু কিছু পরিস্থিতি তে গর্ভাবস্থায় ই সি সেকশন এর অপারেশন পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে। ঐচ্ছিক সিজার যেসব ক্ষেত্রে করা হয়ে থাকেঃ
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা – প্লাসেন্টা প্রিভিয়াঃ
প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল যদি জরায়ুর নিচে অবস্থান করে তখন এই অবস্থাকে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বলে। এই পরিস্থিতি তে অবস্থায় নরমাল ডেলিভারির চেষ্টা করা হলে মায়ের ভারী রক্তপাত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়—যা মা ও গর্ভের শিশু উভয়ের জন্যই খুব ঝুঁকিপূর্ণ।
যমজ শিশুঃ
যদি গর্ভে একের অধিক সন্তান থাকে তখন সি সেকশন অপারেশন দরকার হতে পারে।
প্রসবের রাস্তা ও শিশুর আকারঃ
যদি প্রসবের রাস্তার তুলনায় শিশুর আকার বড় হয় তখন নরমাল ডেলিভারি সম্ভব হয় না সেক্ষেত্রে সি সেকশন অপারেশনের দরকার হয়।
গর্ভের শিশুর অস্বাভাবিক অবস্থানঃ
যদি শিশুর মাথা নিচে না হয়ে পা নিচে এবং মাথা উপরে থাকে তখন এটিকে ব্রীচ পজিশন বলে এক্ষেত্রে সি সেকশন এর মাধ্যমে সন্তান প্রসব নিরাপদ বিবেচনা করা হয়।
মায়ের কিছু স্বাস্থ্য সমস্যাঃ
গর্ভাবস্থায় মায়ের কিছু কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা যেমনঃ উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের কিছু রোগ, ব্রেইনের কিছু রোগে সি সেকশন অপারেশন ঐচ্ছিকভাবে করতে হয়।
পূর্বের সিজারঃ
পূর্বে যদি সি সেকশন অপারেশন হয়ে থাকে, সেলাই এর পূরত্ব ও অনান্য অবস্থা যদি নরমাল ডেলিভারির জন্য নিরাপদ না হয় তখন ডাক্তার সি সেকশন অপারেশনের পরামর্শ দেন।
পরিকল্পিত সি সেকশন অপারেশনের ক্ষেত্রে ডাক্তার আপনাকে সিজারের কথা বললে ডাক্তারের সাথে সি সেকশন অপারেশনের কারণ নিয়ে কথা বলে বিস্তারিত জেনে নেয়া উচিত এতে মানসিক স্বস্তি নিশ্চিত হয় এবং সচেতনতাও উচিত।
সিজারের পর ইনফেকশনের লক্ষণ
সিজারের পর অপারেশনের জায়গায় ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা দেয় কিনা সেই বিষয়ে সতর্ক থাকুন। ইনফেকশনের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে, অপারেশনের জায়গাটি—
১)ফুলে যাওয়া
২)ব্যথা হওয়া
২)অনেক লাল হয়ে যাওয়া
৩)জায়গাটি থেকে পুঁজ বা দুর্গন্ধযুক্ত তরল বের হওয়া
৪)জ্বর আসা
এমন কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন। কারণ ইনফেকশন হলে দ্রুত সঠিক চিকিৎসা না নিলে এতে করে ইনফেকশন রক্তেও ছড়িয়ে যেতে পারে যা খুবই বিপদজনক।
সিজার পরবর্তী সময়ে মায়ের যত্ন
সিজার যেহেতু একটি বড় অপারেশন তাই সি সেকশন অপারেশনের পর আগের মতো পরিপূর্ণ সুস্থ হতে ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে কিছু সময় বেশি লাগবে এটাই স্বাভাবিক । যদিও সি সেকশন অপারেশনের পর স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে সাধারণত প্রায় ১.৫ মাস সময় লাগতে পারে। তবে এই সময়টা একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম। তবে সি সেকশন অপারেশনের পরবর্তী সময়ে পরিপূর্ণ সঠিক যত্ন ও সচেতনতা দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে।
সিজারিয়ান অপারেশনের কাটা স্থানের যত্ন
– কাটা স্থানটি নিয়মিত পরিষ্কার করা তবে বেশি ঘষামাজা না করা। পরিষ্কারের পর জায়গাটি ভালো করে শুকিয়ে ফেলা।
– কাটা স্থানটি ঘেমে ভিজে গেলে, শুকিয়ে ফেলা।
– পরিষ্কার ও সুতি কাপড়ের ঢিলেঢালা পোষাক পরিধান করা।
– যদি শরীরের সাথে না মেশে এমন প্রকৃতির সুতা দিয়ে সেলাই করা হয় তাহলে ৫-৭ দিন পর সেলাই কাটাতে বলা হয় সেক্ষেত্রে সেলাই কাটিয়ে, উক্ত কাটা স্থানটি তে নির্দেশনা অনুযায়ী মলম লাগানো উচিত।
এছাড়াও সি সেকশন অপারেশনের পরবর্তী সময় ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী ঔষধ, ব্যায়াম ও খাবার দাবার নিয়ম অনুযায়ী গ্রহন করা উচিত। যেমনঃ
সিজারের পর খাবার তালিকা
পুষ্টিকর খাবারঃ খাদ্যতালিকায় অবশ্যই পুষ্টিকর খাবার রাখতে হবে। কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে বেশি করে আঁশযুক্ত খাবার, শাক সবজি, ফল মূল ও মাছ মাংস ডিম দুধ ইত্যাদি পুষ্টিকর খাবার রাখুন। এবং সেই সাথে গর্ভাবস্থায় খাওয়া আয়রন ও ক্যালসিয়াম ঔষধ প্রসব পরবর্তী ৩ মাস সেবন করুন। ভিটাসিন সি জাতীয় খাবার খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত।
শারীরিক ব্যায়ামঃ সিজারের পর ভারী কাজ ব্যতীত স্বাভাবিক হাটাহাটি, ঘরের কাজ ইত্যাদি করে শরীরকে সচল রাখুন। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আপনার শরীরের অবস্থা অনুযায়ী পোস্ট ন্যাটাল ব্যায়াম গুলো
করুন। এতে আপনার মাংসপেশি মজবুত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সহায়তা করে।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়াঃ সিজারের পর পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য মায়ের জন্য প্রতিদিন পরিপূর্ণ ঘুম ও বিশ্রাম অনেক জরুরি।
যেসব কাজ থেকে বিরত থাকবেন। সিজারের পরবর্তী ১.৫ মাস কিছু কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে যেমনঃ
– সহবাস করা
– ভারী কাজ করা
– ভারী ব্যায়াম করা
সিজার নিয়ে কিছু কমন প্রশ্ন-
সিজারের কতদিন পর সহবাস করা যায়?
-সিজারের পর সাধারণত প্রায় ১.৫ মাস সহবাস থেকে বিরত থাকতে হবে।
সিজারের কতদিন পর সেলাই শুকায়?
-সিজারের কাটা অংশ পুরোপুরি শুকাতে প্রায় ৬ সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।
সিজারের কতদিন পর ভারী কাজ করা যায়?
-সিজারের পরবর্তী ১.৫ মাস ভারী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
প্রথম সন্তান সিজারিয়ানে হলে দ্বিতীয়বার কি নরমালে হওয়া সম্ভব?
-প্রথমবার সি সেকশন অপারেশন হওয়ার পরও দ্বিতীয়বার নরমাল ডেলিভারি হওয়া সম্ভব এটিকে ভিব্যাক (ভিবিএসি), অর্থাৎ ভ্যাজাইনাল বার্থ আফটার সিজারিয়ান সেকশন বলে। তবে এ জন্য অবশ্যই মায়ের শারীরিক অবস্থা ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে ভিব্যাক যেসব ক্ষেত্রে সম্ভব নয়ঃ
১. পূর্বের সেলাই এর স্থান দুর্বল হলে। তখন ভিব্যাক করালে জরায়ু ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে
২. বয়স চল্লিশের বেশি হলে।
এছাড়া ডায়বেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ এর সমস্যা থাকলে ভিব্যাক এর চেষ্টা না করাই উত্তম।
৩. প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বা গর্ভফুল নিচের দিকে হলে।
ভিব্যাক করতে হলে আগে অবশ্যই অভিজ্ঞ ডাক্তার ও পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধাসম্পন্ন হসপিটাল পছন্দ করতে হবে।
সিজারের পর কী কী খাওয়া যাবে না?
-সি সেকশন অপারেশনের পর
১)ভাজা-পোড়া
২)কার্বনেটেড ড্রিংক বা কোমল পানীয়
৩)চা-কফি জাতীয় খাবার
৪)অ্যালকোহল ইত্যাদি খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
অপারেশনের পর শারীরিক ভাবে বেশি অসুস্থতা বোধ করলে অবহেলা না করে দ্রুতই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
~সিজারিয়ান সেকশন ও এর পরবর্তী যত্ন